গরুর গলাফুলা রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা

গরুর গলাফুলা (Hemorrhagic Septicemia) একটি গুরুতর সংক্রামক রোগ যা মূলত Pasteurella multocida ব্যাকটেরিয়ার কারণে ঘটে। এটি সাধারণত বর্ষাকালে বা শীত মৌসুমে বেশি দেখা যায় এবং দ্রুত চিকিৎসা না করলে প্রাণঘাতী হতে পারে। নিচে গরুর গলাফুলা রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা তুলে ধরা হলো:

গরুর গলাফুলা

গলাফুলা রোগের কারণ:

১. ব্যাকটেরিয়া:

Pasteurella multocida নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে এই রোগ হয়।


২. অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ:

মলমূত্রের সঙ্গে মিশে থাকা ব্যাকটেরিয়া সহজেই সংক্রমণ ঘটায়।


৩. বায়ু দ্বারা সংক্রমণ:

আক্রান্ত পশুর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।


৪. জল-খাদ্য থেকে সংক্রমণ:

দূষিত জল বা খাদ্য গ্রহণ করলে রোগটি হতে পারে।


৫. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব:

দুর্বল বা অপুষ্ট পশু সহজেই আক্রান্ত হয়।


আরো পড়ুনঃ>>গরুর বাদলা রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার


গলাফুলা রোগের লক্ষণ:
শারীরিক লক্ষণ:

১. গলার চারপাশ ফুলে যায়।


২. শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় (১০৪°F–১০৬°F পর্যন্ত)।


৩. গলা ও ঘাড়ে ব্যথা হয়।


৪. মুখ দিয়ে লালা পড়া শুরু হয়।


৫. দাঁত ঘষা বা অসহ্য ব্যথার লক্ষণ প্রকাশ করে।


শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত লক্ষণ:

৬. শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।


৭. দ্রুত ও অস্বাভাবিক শ্বাস।


৮. নাক দিয়ে সাদা বা রক্তমিশ্রিত শ্লেষ্মা বের হয়।


জীবনশক্তি হ্রাস:

৯. খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।


১০. শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।


১১. চেহারা বিষণ্ণ ও অলস হয়ে যায়।


অন্যান্য লক্ষণ:

১২. মলের রঙ পরিবর্তন বা পাতলা মলত্যাগ।


১৩. ত্বক ও চোখের চারপাশ লালচে বা ফ্যাকাশে।


১৪. অনিয়মিত হৃদস্পন্দন।


গলাফুলা রোগের প্রভাব:

১. দ্রুত চিকিৎসা না করলে গরু ২৪–৭২ ঘণ্টার মধ্যে মারা যেতে পারে।


২. প্রজনন ক্ষমতা কমে যেতে পারে।


৩. রোগটি ছড়িয়ে পড়লে পুরো খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


৪. উৎপাদনশীলতা (দুধ, মাংস) কমে যায়।


গলাফুলা রোগ প্রতিরোধ:
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা:

১. খামারের পরিবেশ সবসময় পরিষ্কার রাখা।


২. পশুর পানির উৎস ও খাদ্যদ্রব্য জীবাণুমুক্ত রাখা।


৩. মলমূত্র নিয়মিত পরিষ্কার করা।


টিকাদান:

৪. গলাফুলা রোগের টিকা (Hemorrhagic Septicemia Vaccine) বছরে একবার দেওয়া।


৫. বর্ষাকালের আগে (এপ্রিল-মে) টিকা নিশ্চিত করা।


পুষ্টিকর খাবার:

৬. পশুকে সুষম খাদ্য ও পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা।


৭. খনিজ লবণ ও ভিটামিন যুক্ত খাবার দেওয়া।


আক্রান্ত পশু পৃথকীকরণ:

৮. যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে আক্রান্ত পশুকে অন্যদের থেকে আলাদা রাখা।


৯. আক্রান্ত পশুর জায়গা জীবাণুমুক্ত করা।


গলাফুলা রোগের চিকিৎসা:
প্রাথমিক চিকিৎসা:

১. পশুকে আলাদা করে ছায়াযুক্ত জায়গায় রাখা।


২. পর্যাপ্ত পানি ও পুষ্টিকর খাবার দেওয়া।


৩. দ্রুত ভেটেরিনারিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করা।


ঔষধ প্রয়োগ:

৪. অ্যান্টিবায়োটিক:

Oxytetracycline, Penicillin, অথবা Streptomycin ব্যবহার করা হয়।

ডোজ: গরুর ওজন অনুযায়ী ডোজ নির্ধারণ।


৫. অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস:

ব্যথা ও ফুলাভাব কমানোর জন্য।


৬. Fluids Therapy:

শরীরের পানিশূন্যতা দূর করতে স্যালাইন বা অন্যান্য তরল প্রয়োগ।


বিশেষ চিকিৎসা:

৭. গলায় ইনজেকশন:

Pasteurella ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে প্রয়োজনীয় ইনজেকশন দেওয়া হয়।


৮. ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট:

ভিটামিন এ, ডি, ই ও বি কমপ্লেক্স সাপ্লিমেন্ট প্রদান।


৯. ইমিউন বুস্টার:

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাপ্লিমেন্ট।


গলাফুলা রোগে সচেতনতার ভূমিকা:
খামারিদের করণীয়:

১. রোগের প্রাথমিক লক্ষণ সম্পর্কে জানা।


২. সময়মতো টিকাদান নিশ্চিত করা।


৩. পশুদের জন্য সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখা।


সরকারি উদ্যোগ:

৪. রোগ প্রতিরোধে বিশেষ ক্যাম্পেইন।


৫. ভেটেরিনারি সেবা সহজলভ্য করা।


৬. কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া।


গরুর গলাফুলা রোগ দ্রুত ছড়ায় এবং এটি প্রাণঘাতী হতে পারে। তাই প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত টিকাদান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং সুষম খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। সচেতনতা ও সঠিক ব্যবস্থাপনাই গরুর গলাফুলা রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার মূল চাবিকাঠি।


Comments

Popular posts from this blog

হাঁস কত দিনে ডিম পাড়ে এবং ডিম পাড়া হাঁসের সঠিক পরিচর্যা

মাংস উৎপাদনের জন্য লাভজনক হাঁসের জাত ও তাদের পালন পদ্ধতি

দেশি মুরগি কত দিনে ডিম পাড়ে এবং ডিম পাড়া মুরগি সঠিক পরিচর্যা