মুরগির গামবোরো রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
গামবোরো রোগ (Gumboro Disease) বা ইনফেকশিয়াস বার্সাল ডিজিজ (IBD) একটি মারাত্মক ভাইরাসজনিত রোগ। এটি মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে তোলে এবং প্রায়শই ৩-৬ সপ্তাহ বয়সী মুরগির মধ্যে বেশি দেখা যায়। রোগটি বার্সা অব ফেব্রিসিয়াস (Bursa of Fabricius) নামে একটি বিশেষ অঙ্গকে প্রভাবিত করে।
গামবোরো রোগের প্রধান লক্ষণসমূহ:
১. সাধারণ লক্ষণ:
মুরগি খেতে অনীহা দেখায়।
শরীরের পানি ও ওজন কমে যায়।
পালকগুলো এলোমেলো হয়ে থাকে।
২. শারীরিক লক্ষণ:
শরীরে ঝিম ধরা অবস্থা।
পেটের নিচে ফুলে যাওয়া।
নরম বা ঝুলে পড়া পালক।
শরীর কাঁপা বা জ্বরের মতো উপসর্গ।
৩. মলের পরিবর্তন:
পাতলা সাদা বা পানির মতো ডায়রিয়া।
মলে হলুদাভ বা সবুজাভ বর্ণ।
মলের সঙ্গে অতিরিক্ত আমাশা।
৪. আচরণগত লক্ষণ:
মুরগি একপাশে পড়ে থাকা বা স্থির বসে থাকা।
দলবদ্ধভাবে থাকা বন্ধ করে একাকী হয়ে পড়া।
হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাওয়া।
৫. বিশেষ লক্ষণ:
বার্সা অঙ্গ ফোলা ও লালচে হয়ে যাওয়া।
পা ও পায়ের পাতায় নীলচে আভা দেখা।
মুরগির মৃত্যু হার বৃদ্ধি।
গামবোরো রোগের কারণ:
১. ভাইরাস:
রোগটি বার্না ভাইরাস (Birnavirus) দ্বারা সৃষ্ট।
ভাইরাসটি অত্যন্ত সংক্রামক এবং দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারে।
২. পরিবেশগত কারণ:
অপরিষ্কার ও জীবাণুযুক্ত খামার।
ঘনবসতিপূর্ণ মুরগির খাঁচা।
দূষিত খাবার ও পানি।
৩. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া:
রোগটি সরাসরি মুরগির ইমিউন সিস্টেমকে আক্রমণ করে।
টিকার অভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়।
গামবোরো রোগের সংক্রমণ পদ্ধতি:
মলের মাধ্যমে: সংক্রমিত মুরগির মল থেকে ভাইরাস ছড়ায়।
পানীয় বা খাদ্য: দূষিত পানি বা খাবার থেকে সংক্রমণ।
মানুষের মাধ্যমে: আক্রান্ত মুরগি ধরার পরে জীবাণু অন্য মুরগির মধ্যে ছড়ানো।
পরিবেশ: ভাইরাস দীর্ঘদিন পরিবেশে সক্রিয় থাকতে পারে।
গামবোরো রোগের প্রতিকার:
১. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:
গামবোরো রোগের সরাসরি কোনো নিরাময় নেই, তবে প্রতিরোধই সবচেয়ে কার্যকর পন্থা।
টিকাদান:
৭-১৪ দিনের মধ্যে বাচ্চা মুরগিকে গামবোরো ভ্যাকসিন দিতে হবে।
দ্বিতীয় ডোজ ১৮-২১ দিনের মধ্যে।
প্রয়োজন অনুসারে ব্রিডার মুরগিকে বুস্টার ডোজ।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা:
খামার ও সরঞ্জাম নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করা।
জীবাণুনাশক স্প্রে করা।
কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা:
নতুন মুরগি আনার আগে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন।
আক্রান্ত মুরগিকে পৃথক স্থানে রাখা।
২. উপশম চিকিৎসা:
গামবোরো রোগের কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই, তবে মুরগির দেহের শক্তি বৃদ্ধির জন্য সাপোর্টিভ চিকিৎসা দেওয়া হয়।
ইলেক্ট্রোলাইট:
পানির সঙ্গে ইলেক্ট্রোলাইট মিশিয়ে দেওয়া।
ভিটামিন:
ভিটামিন এ, ডি, এবং ই মিশ্রিত খাবার।
ভিটামিন সি দেওয়া শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
প্রাকৃতিক উপায়:
হলুদ ও আদার রস মিশ্রিত পানি।
গরম মশলা মিশ্রিত খাদ্য।
৩. পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা:
খামার শুকনো ও পরিচ্ছন্ন রাখা।
খামারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা।
দূষিত খাবার ও পানির ব্যবহার বন্ধ করা।
গামবোরো রোগ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার উপায়:
১. সঠিক খাদ্য ও পুষ্টি:
উচ্চ মানের ফিড প্রদান।
ফিডে সঠিক পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ উপাদান নিশ্চিত করা।
২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা:
মুরগির বাচ্চা কেনার সময় স্বাস্থ্য পরীক্ষা।
মানসম্পন্ন ভ্যাকসিনের ব্যবহার।
৩. সঠিক খামার ব্যবস্থাপনা:
খাঁচা যথেষ্ট বড় এবং মুরগির জন্য আরামদায়ক হওয়া উচিত।
খামারে বায়ুচলাচলের সঠিক ব্যবস্থা।
নিয়মিত জীবাণুনাশক স্প্রে করা।
৪. নিয়মিত পরিদর্শন ও পরীক্ষা:
মুরগির শরীরের কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।
স্থানীয় ভেটেরিনারি চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা।
গামবোরো রোগ নিয়ন্ত্রণের সেরা কৌশল:
সময়মতো টিকা দেওয়া।
পরিচ্ছন্ন খামার পরিবেশ বজায় রাখা।
রোগ প্রতিরোধে সচেতন থাকা।
গামবোরো রোগ মুরগির খামারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সঠিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও কার্যকর টিকা ব্যবহারের মাধ্যমে এ রোগ থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সঠিক পরিচর্যা ও খামার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা মুরগির সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়ক।
Comments
Post a Comment