বড় মুরগির রানিখেত রোগের উপসর্গ ও চিকিৎসা
রানিখেত রোগ (Newcastle Disease) একটি অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাসজনিত রোগ, যা মুরগি এবং পাখির জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে। এটি Paramyxovirus দ্বারা সৃষ্ট এবং দ্রুত এক মুরগি থেকে অন্য মুরগিতে ছড়িয়ে পড়ে। নিচে উপসর্গ, কারণ এবং চিকিৎসার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো।
রানিখেত রোগের কারণ:
১. ভাইরাস: এটি Paramyxovirus গ্রুপের RNA ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট।
২. সংক্রমণের মাধ্যম:
আক্রান্ত মুরগির লালা, মল, বা নিঃসৃত পদার্থ।
দূষিত খাবার, পানি এবং সরঞ্জাম।
বন্য পাখি, ইঁদুর বা অন্যান্য বাহক।
৩. দুর্বল ইমিউন সিস্টেম এবং প্রতিরোধের অভাব
রানিখেত রোগের উপসর্গ:
১. শ্বাসতন্ত্রের উপসর্গ:
হাঁসফাঁস করা।
নাক দিয়ে শ্লেষ্মা ঝরা।
শ্বাসকষ্ট এবং গলার আওয়াজ।
২. স্নায়ুবিক উপসর্গ:
ঘাড় বাঁকা হয়ে যাওয়া।
পা বা ডানা প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া।
ভারসাম্যহীন হয়ে হাঁটা বা ঘূর্ণন।
৩. অন্ত্রীয় উপসর্গ:
সবুজ বা সাদা পাতলা পায়খানা।
খাদ্য গ্রহণে অনীহা।
দ্রুত ওজন কমে যাওয়া।
৪. সাধারণ উপসর্গ:
ডিম উৎপাদন হ্রাস (ডিমের খোসা পাতলা বা বিকৃত হওয়া)।
গলায় গুটি দেখা বা ফুলে যাওয়া।
অস্বাভাবিক ক্লান্তি এবং স্থির হয়ে থাকা।
জ্বর (শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি)।
অতিরিক্ত মৃত্যু (ঝাঁকে ঝাঁকে মুরগি মারা যাওয়া)।
রানিখেত রোগের ধরন:
১. ভেলোজেনিক ফর্ম:
সবচেয়ে মারাত্মক।
হঠাৎ মৃত্যু বা ১০০% মুরগির মৃত্যু।
২. মেসোজেনিক ফর্ম:
মাঝারি মাত্রার রোগ।
ডিম উৎপাদন হ্রাস এবং শ্বাসকষ্ট।
৩. লেন্টোজেনিক ফর্ম:
মৃদু উপসর্গ।
সাধারণত শ্বাসতন্ত্র আক্রান্ত।
রানিখেত রোগ প্রতিরোধ:
১. টিকাদান:
লাসোটা ভ্যাকসিন (বাচ্চা মুরগির জন্য)।
F1 ভ্যাকসিন: বড় মুরগির জন্য কার্যকর।
জন্মের ৫-৭ দিনের মধ্যে এবং পরে ৪-৮ সপ্তাহ বয়সে টিকা দিন।
প্রতি ৬ মাস অন্তর টিকা পুনরায় প্রদান করা।
২. বায়োসিকিউরিটি ব্যবস্থা:
খামারে বাইরের ব্যক্তিদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা।
মুরগির খাঁচা, পানি ও খাবারের পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার করা।
সংক্রমিত মুরগিকে দ্রুত আলাদা করা।
খামারে বন্য পাখি এবং ইঁদুর প্রবেশ রোধ।
৩. সুষম খাবার ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ:
মুরগির জন্য পুষ্টিকর খাবার এবং বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা।
খামার শুকনো এবং পরিষ্কার রাখা।
রানিখেত রোগের চিকিৎসা:
১. প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা:
রোগ প্রতিরোধে টিকা দেওয়া সর্বোত্তম উপায়।
আক্রান্ত মুরগিকে সঠিকভাবে আলাদা করতে হবে।
২. সাপোর্টিভ চিকিৎসা:
এন্টিবায়োটিক:
সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ ঠেকাতে।
যেমন: Oxytetracycline, Enrofloxacin।
ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট:
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ভিটামিন এ, সি, এবং ই।
ইলেক্ট্রোলাইট সলিউশন:
পানিশূন্যতা পূরণে।
যেমন: ORS বা গ্লুকোজ সলিউশন।
৩. ঘরোয়া চিকিৎসা:
লবণ ও চিনি মিশ্রিত পানি পান করানো।
রসুন এবং হলুদ মিশ্রিত খাদ্য দেওয়া।
৪. ইমিউন বুস্টার:
Probiotic এবং Prebiotic ব্যবহার করে মুরগির ইমিউনিটি বাড়ানো।
ভেষজ ওষুধ (যেমন তুলসী পাতা বা নিম পাতা) দিতে পারেন।
রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি হ্রাস করার উপায়:
১. আক্রান্ত মুরগি বা মৃত মুরগি নিরাপদে পুঁতে ফেলা বা পুড়িয়ে ধ্বংস করা।
১. মুরগির খামারে নতুন মুরগি আনার আগে সেগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা।
৩. খামারে জীবাণুনাশক স্প্রে করা।
৪. নির্দিষ্ট বুট, পোশাক, এবং সরঞ্জাম ব্যবহার করা।
জরুরি পদক্ষেপ:
১. রোগ দেখা দিলে দ্রুত ভেটেরিনারি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
২. সংক্রমণের মাত্রা অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।
৩. খামারে টিকাদান নিশ্চিত করুন।
৪. টিকা দেওয়ার সময় নির্দেশিকা মেনে চলুন (যেমন: সঠিক ডোজ, ফ্রিজে সংরক্ষণ)।
সংক্ষেপে প্রতিরোধ ও চিকিৎসার গুরুত্ব:
রানিখেত রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসার তুলনায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা বেশি কার্যকর। এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং মুরগির মৃত্যুর হার খুব বেশি। তাই নিয়মিত টিকাদান, বায়োসিকিউরিটি ব্যবস্থা এবং খামারের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।
দ্রষ্টব্য: রানিখেত রোগের নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। সাপোর্টিভ চিকিৎসা এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
Comments
Post a Comment