ছাগলের পিপিআর রোগ কি ও তার প্রতিকার
পিপিআর (Peste des Petits Ruminants) একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা প্রধানত ছাগল এবং ভেড়ার মধ্যে ছড়ায়। এটি ছাগলের জন্য অত্যন্ত মারাত্মক এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ করা সম্ভব। পিপিআর রোগ এবং তার প্রতিকার গুলো হলো:
পিপিআর রোগ: পরিচিতি ও কারণ:
১. রোগের নাম: পিপিআর (ছাগলের প্লেগ নামেও পরিচিত)।
২. কারণ: পিপিআর ভাইরাস (মোরবিলি ভাইরাস)।
৩. ক্ষতিগ্রস্ত প্রাণী: ছাগল ও ভেড়া প্রধানত আক্রান্ত হয়।
৪. ছড়িয়ে পড়ার পদ্ধতি:
সংস্পর্শে আসা
আক্রান্ত পশুর লালা, মলমূত্র এবং শ্বাসের মাধ্যমে।
খাবার, পানি ও খামারের যন্ত্রপাতি দ্বারা।
৫. মর্টালিটি রেট: প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ৫০-১০০% হতে পারে।
পিপিআর রোগের লক্ষণসমূহ:
১. প্রাথমিক লক্ষণ:
জ্বর (১০৪-১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত)।
ক্লান্তি ও দুর্বলতা।
২. শ্বাসতন্ত্রের লক্ষণ:
নাক দিয়ে পানি পড়া।
শ্বাসকষ্ট।
৩. হজম তন্ত্রের লক্ষণ:
ডায়রিয়া।
মুখে এবং জিহ্বায় ঘা।
৪. চর্মলক্ষণ:
মুখের চারপাশে চামড়া শুকিয়ে ফাটা।
চোখে এবং নাকে পুঁজের মতো পদার্থ জমা।
৫. খাদ্য গ্রহণে অরুচি:
পশু খাবার খেতে অনিচ্ছুক হয়।
৬. বংশবৃদ্ধি ব্যাহত:
আক্রান্ত পশুর প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়।
রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি:
১. লক্ষণ পর্যবেক্ষণ: উল্লেখিত উপসর্গগুলোর উপস্থিতি পরীক্ষা করা।
২. ল্যাব টেস্ট:
ব্লাড টেস্ট।
পিসিআর পরীক্ষা।
৩. ভেটেরিনারিয়ানের পরামর্শ: সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য পশু চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ।
পিপিআর রোগের প্রতিকার:
১. সংক্রমিত পশুর আলাদা ব্যবস্থা:
আক্রান্ত পশুকে দ্রুত আলাদা স্থানে রাখতে হবে।
খামারে অন্য পশুর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করতে হবে।
২. পর্যাপ্ত পানি ও খাবার সরবরাহ:
রোগাক্রান্ত পশুর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার ও পানি সরবরাহ করতে হবে।
পুষ্টিকর খাদ্য যোগ করা উচিত।
৩. ওষুধের ব্যবহার:
অ্যান্টিবায়োটিক: দ্বিতীয় সংক্রমণ প্রতিরোধে।
অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ: জ্বর কমাতে।
তরল থেরাপি: ডায়রিয়ার কারণে পানিশূন্যতা পূরণ করতে।
৪. ভিটামিন ও মিনারেল সরবরাহ:
পশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন এ, সি এবং জিঙ্ক দেওয়া যেতে পারে।
৫. পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা:
রোগ ছড়ানো বন্ধ করতে জীবাণুনাশক দিয়ে খামার পরিষ্কার করা।
আক্রান্ত পশুর ব্যবহার করা খাবার ও পানির পাত্র জীবাণুমুক্ত করা।
পিপিআর রোগের প্রতিরোধ:
১. টিকাদান কর্মসূচি:
নিয়মিত পিপিআর টিকা প্রদান।
৩-৪ মাস বয়সের ছাগলকে প্রথম টিকা এবং প্রতি বছর পুনরায় টিকা দেওয়া।
২. কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা:
নতুন যোগ করা পশু ২১ দিন আলাদা রাখা।
সন্দেহজনক পশুকে খামারের বাইরে রাখা।
৩. খামারের পরিচ্ছন্নতা:
খামার, খাদ্য ও পানির ট্যাংক নিয়মিত পরিষ্কার রাখা।
খামারে জীবাণুনাশক ছিটানো।
৪. রোগ ছড়ানো বন্ধে ব্যবস্থা:
আক্রান্ত পশুর মৃতদেহ সঠিকভাবে পুঁতে ফেলা।
আক্রান্ত খামারে অন্য পশু প্রবেশ বন্ধ করা।
৫. পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ:
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পুষ্টিকর খাদ্য প্রদান।
খাদ্যে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল মিশ্রিত করা।
৬. সচেতনতা বৃদ্ধি:
খামারিদের প্রশিক্ষণ ও সচেতন করা।
পিপিআর রোগের লক্ষণ এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে প্রচারণা।
সরকার ও ভেটেরিনারি বিভাগের ভূমিকা:
১. টিকা সরবরাহ:
সাশ্রয়ী মূল্যে পিপিআর টিকা সরবরাহ করা।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা।
২. রোগ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন:
প্রতিটি অঞ্চলে রোগ পর্যবেক্ষণ করা।
রোগ শনাক্তকরণে ল্যাব সুবিধা প্রদান।
৩. সচেতনতা কর্মসূচি:
কৃষক ও খামারিদের প্রশিক্ষণ।
পিপিআর রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে প্রচারণা।
অর্থনৈতিক দিক:
১. ক্ষতির ধরন:
পশুর মৃত্যু।
উৎপাদনশীলতা হ্রাস।
প্রজনন ব্যাহত।
২. প্রতিরোধের মাধ্যমে লাভ:
টিকাদান কর্মসূচি সফল হলে ক্ষতি কমানো সম্ভব।
সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়।
পরিশেষে বলা যায় পিপিআর রোগ একটি প্রাণঘাতী রোগ হলেও সঠিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। টিকাদান, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে খামারের পশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে। রোগের প্রাদুর্ভাব রোধে খামারিদের পাশাপাশি সরকার ও ভেটেরিনারি বিভাগের সক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Comments
Post a Comment