কুকুর বা বিড়ালের কামড়ে জলাতঙ্কের ঝুঁকি এবং প্রাথমিক চিকিৎসা
জলাতঙ্ক (Rabies) একটি মারাত্মক ভাইরাসজনিত রোগ, যা সংক্রমিত প্রাণীর কামড়, আঁচড়, বা লালার মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে এবং যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা না পেলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তাই কুকুর বা বিড়ালের কামড়ের পর দ্রুত সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। কুকুর বা বিড়ালের কামড়ের ক্ষেত্রে জলাতঙ্ক প্রতিরোধে প্রাথমিক চিকিৎসার ধাপ এবং করণীয়:
১. কামড়ের পর প্রথম পদক্ষেপঃ
১. আতঙ্কিত না হওয়াঃ
কামড় বা আঁচড়ের পর মানসিকভাবে শান্ত থাকুন এবং দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করুন।
২. ক্ষত স্থান পরিষ্কার করাঃ
কামড় বা আঁচড়ের স্থান জল দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন।
অন্তত ১০-১৫ মিনিট ধরে প্রবাহিত পানি ব্যবহার করে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করুন।
ক্ষত পরিষ্কার করার সময় জীবাণুনাশক সাবান বা ডিটারজেন্ট ব্যবহার করুন।
৩. ক্ষত জীবাণুমুক্ত করাঃ
পরিষ্কার করার পর ক্ষতস্থানে অ্যান্টিসেপটিক (যেমন বেটাডিন) লাগান।
অ্যালকোহল বা আয়োডিন সমাধানও ক্ষত জীবাণুমুক্ত করতে কার্যকর।
৪. ক্ষত বাঁধন এড়িয়ে চলাঃ
ক্ষতস্থান ঢেকে রাখার জন্য কোনো আঁটসাঁট ব্যান্ডেজ বা কাপড় ব্যবহার করবেন না।
ক্ষত শুকানোর জন্য উন্মুক্ত রাখুন।
আরো পড়ুনঃ>> শিয়ালের মাংস মানুষ কেন খায় এবং উপকারিতা
২. দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে যাওয়াঃ
১. দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া:
কুকুর বা বিড়ালের কামড়ের পর যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান।
ডাক্তারের কাছে জলাতঙ্কের টিকা এবং চিকিৎসার বিষয়ে পরামর্শ নিন।
২. জলাতঙ্ক প্রতিরোধক টিকা নেওয়া:
কামড়ের পর জলাতঙ্ক প্রতিরোধের জন্য Post-Exposure Prophylaxis (PEP) টিকা নিতে হবে।
টিকা দেওয়ার সময়সূচি মেনে চলুন (যেমন প্রথম দিন, তৃতীয় দিন, সপ্তম দিন এবং ২৮তম দিন)।
৩. ইমিউনোগ্লোবুলিন ইনজেকশন:
যদি কামড়টি গুরুতর হয়, তবে চিকিৎসক জলাতঙ্ক ইমিউনোগ্লোবুলিন (Rabies Immunoglobulin) প্রয়োগ করতে পারেন।
এটি ক্ষতস্থানের চারপাশে প্রয়োগ করা হয়।
৩. কামড়ের ঝুঁকি মূল্যায়নঃ
১. কামড়ের ধরন:
তুচ্ছ কামড় বা আঁচড়: ত্বক ভেদ না করে হালকা আঁচড়।
গুরুতর কামড়: ত্বক ভেদ করে রক্তপাত হওয়া।
২. আক্রান্ত প্রাণীর পর্যবেক্ষণ:
কামড়ানো প্রাণীটি জলাতঙ্কে আক্রান্ত কি না তা পর্যবেক্ষণ করুন।
কামড়ানোর পর ১০ দিন ধরে পোষা প্রাণীটিকে নজরে রাখুন।
৩. বেওয়ারিশ প্রাণী:
যদি কামড়ানো প্রাণী বেওয়ারিশ হয় বা পালাতে পারে, তাহলে জলাতঙ্কের ঝুঁকি বেশি।
এ ক্ষেত্রে অবিলম্বে চিকিৎসা গ্রহণ করুন।
৪. জলাতঙ্কের লক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতাঃ
১. কামড়ানো প্রাণীর লক্ষণ:
অস্বাভাবিক আচরণ, অতিরিক্ত লালা ঝরা।
আক্রমণাত্মক হওয়া বা জল থেকে ভয় পাওয়া।
২. মানুষের মধ্যে জলাতঙ্কের লক্ষণ:
জ্বর, মাথা ব্যথা এবং বমি বমি ভাব।
স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা, জল থেকে ভয়, অস্থিরতা।
শ্বাসকষ্ট এবং গলায় সংকোচ।
৫. জলাতঙ্ক প্রতিরোধে করণীয়ঃ
১. পোষা প্রাণীর টিকাদান:
পোষা কুকুর বা বিড়ালকে নিয়মিত জলাতঙ্ক টিকা দিন।
২. অচেনা প্রাণী এড়িয়ে চলা:
অচেনা বা বেওয়ারিশ প্রাণীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করবেন না।
৩. জলাতঙ্ক সচেতনতা বৃদ্ধি:
জলাতঙ্ক সম্পর্কে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করুন।
কামড়ের পর কী করা উচিত তা জানানো।
৪. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা:
পোষা প্রাণীর আচরণে পরিবর্তন হলে দ্রুত ভেটেরিনারির পরামর্শ নিন।
৬. কামড় থেকে সুরক্ষার উপায়ঃ
১. প্রাণীর আচরণ বোঝা:
কুকুর বা বিড়ালের কাছাকাছি গেলে তাদের আচরণ বুঝে এগিয়ে যান।
প্রাণী বিরক্ত বা উত্তেজিত হলে তাদের বিরক্ত করবেন না।
২. সঠিক আচরণ শিক্ষা:
শিশুদের শেখান যে অপরিচিত প্রাণীকে বিরক্ত না করতে।
৩. প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ:
যেসব এলাকায় জলাতঙ্কের প্রাদুর্ভাব বেশি, সেখানকার প্রাণীদের বিষয়ে সতর্ক থাকুন।
৭. জলাতঙ্কের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ স্থান বা পরিস্থিতিঃ
১. গ্রামীণ এলাকা:
যেখানে বেওয়ারিশ কুকুর বা বিড়ালের সংখ্যা বেশি।
২. বন্যপ্রাণীর এলাকা:
বন্যপ্রাণীর সংস্পর্শে আসা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
৩. স্বাস্থ্যসেবা অভাব:
যেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই।
৮. ভুল ধারণা এবং সতর্কতাঃ
১. কামড়ের গুরুত্ব উপেক্ষা করা:
হালকা আঁচড় বা কামড়ও জলাতঙ্ক সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
২. তদারকি না করা:
কামড়ানো প্রাণীটি পোষা হলেও, টিকা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
৩. ঘরোয়া চিকিৎসায় নির্ভরতা:
প্রাথমিক পরিচর্যা করলেও, ডাক্তারি চিকিৎসা বাধ্যতামূলক।
কুকুর বা বিড়ালের কামড়ের পর দ্রুত সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জলাতঙ্ক প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক চিকিৎসা এবং সঠিক চিকিৎসা সময়মতো গ্রহণ করলে প্রাণঘাতী এই রোগ এড়ানো সম্ভব। সচেতনতা এবং সতর্কতার মাধ্যমে জলাতঙ্কের ঝুঁকি থেকে নিজেকে এবং সমাজকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।
Comments
Post a Comment