ব্রয়লার মুরগির প্রাথমিক রোগ ও চিকিৎসা
ব্রয়লার মুরগি পালন একটি লাভজনক ব্যবসা হলেও মুরগির বিভিন্ন রোগের কারণে অনেক সময় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এসব রোগের সঠিক সময় শনাক্ত ও প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করলে ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব। নিচে ব্রয়লার মুরগির প্রাথমিক রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. শ্বাসতন্ত্রের রোগ:
লক্ষণ:
হাঁচি, কাশির মতো শব্দ।
নাক দিয়ে পানি পড়া।
শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।
কারণ:
ভাইরাস (যেমন: নিউক্যাসল বা ইনফ্লুয়েঞ্জা)।
ব্যাকটেরিয়া (যেমন: মাইকোপ্লাজমা)।
প্রাথমিক চিকিৎসা:
মুরগির ঘর সবসময় শুকনো ও পরিষ্কার রাখা।
বায়ো-সিকিউরিটি বজায় রাখা।
টিলমাইকোসিন বা টাইলোসিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা।
২. কক্সিডিওসিস:
লক্ষণ:
পাতলা বা রক্তমিশ্রিত মল।
দুর্বলতা এবং খাবার গ্রহণে অনীহা।
কারণ:
কক্সিডিয়া নামক পরজীবী।
অপরিষ্কার পরিবেশ।
প্রাথমিক চিকিৎসা:
অ্যান্টি-কক্সিডিয়াল ওষুধ (যেমন: অ্যাম্প্রোলিয়াম) খাওয়ানো।
ঘরের মেঝে শুকনো রাখা।
খাদ্যে কক্সিডিওসিস প্রতিরোধক মেশানো।
৩. নিউক্যাসল ডিজিজ (রানিক্ষেত):
লক্ষণ:
শ্বাসকষ্ট।
গলা বাঁকা হয়ে যাওয়া।
ডিম পাড়ায় ঘাটতি।
কারণ:
নিউক্যাসল ভাইরাস।
প্রাথমিক চিকিৎসা:
কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই।
প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত টিকা দেওয়া।
অসুস্থ মুরগি আলাদা করে ফেলা।
আরো পড়ুনঃ>>ব্রয়লার মুরগি পালন পদ্ধতি
৪. ই-কোলাই ইনফেকশন:
লক্ষণ:
শ্বাসকষ্ট।
চোখ থেকে পানি পড়া।
শরীরে দুর্বলতা।
কারণ:
ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া।
প্রাথমিক চিকিৎসা:
এন্টিবায়োটিক ব্যবহার (যেমন: এনরোফ্লক্সাসিন)।
খাবার ও পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
মুরগির ঘর পরিষ্কার রাখা।
৫. এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা (বার্ড ফ্লু):
লক্ষণ:
শ্বাসকষ্ট।
ডিমের আকার বা রঙের পরিবর্তন।
হঠাৎ করে অনেক মুরগি মারা যাওয়া।
কারণ:
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস।
প্রাথমিক চিকিৎসা:
কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই।
মুরগি আলাদা করে ফেলা।
সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
৬. সালমোনেলোসিস:
লক্ষণ:
পাতলা পায়খানা।
শরীরে কম্পন।
খাদ্যে অনীহা।
কারণ:
সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া।
প্রাথমিক চিকিৎসা:
মুরগিকে ওষুধ খাওয়ানো (যেমন: ফুরাজোলিডোন, এনরোফ্লক্সাসিন)।
খাবার ও পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
৭. গাম্বোরো ডিজিজ:
লক্ষণ:
গায়ে জ্বর।
দ্রুত ওজন কমে যাওয়া।
লোম-ভঙ্গুরতা।
কারণ:
গাম্বোরো ভাইরাস।
প্রাথমিক চিকিৎসা:
প্রাথমিকভাবে নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই।
প্রতিরোধের জন্য টিকা দেওয়া।
৮. হিট স্ট্রেস (তাপজনিত সমস্যা):
লক্ষণ:
হাঁ করে শ্বাস নেওয়া।
পানির প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ।
মৃত্যুর হার বৃদ্ধি।
কারণ:
অতিরিক্ত তাপমাত্রা।
প্রাথমিক চিকিৎসা:
মুরগির ঘর ঠাণ্ডা রাখা।
পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা।
ইলেক্ট্রোলাইট মেশানো পানি খাওয়ানো।
৯. পুষ্টি ঘাটতিজনিত রোগ:
লক্ষণ:
হাড়ের বৃদ্ধি কমে যাওয়া।
ডিম পাড়ায় সমস্যা।
কারণ:
খাদ্যে পুষ্টির অভাব।
প্রাথমিক চিকিৎসা:
সুষম খাদ্য সরবরাহ করা।
ভিটামিন ও মিনারেল সম্পূরক মেশানো।
১০. মাইকোটক্সিকোসিস:
লক্ষণ:
খাবারের প্রতি অনীহা।
পাতলা পায়খানা।
শরীরে দুর্বলতা।
কারণ:
ফাঙ্গাসযুক্ত খাবার।
প্রাথমিক চিকিৎসা:
পরিষ্কার এবং তাজা খাবার সরবরাহ।
অ্যান্টি-মাইকোটক্সিন ওষুধ প্রয়োগ।
১১. ফুটপ্যাড ডারমাটাইটিস:
লক্ষণ:
পায়ের তলায় ক্ষত।
হাঁটতে কষ্ট হওয়া।
কারণ:
ঘরের মেঝে ভেজা থাকা।
প্রাথমিক চিকিৎসা:
শুকনো ও পরিষ্কার লিটার ব্যবহার।
ক্ষতস্থানে অ্যান্টিসেপটিক প্রয়োগ।
১২. পরজীবীজনিত সংক্রমণ:
লক্ষণ:
পালক মলিন হওয়া।
ওজন কমে যাওয়া।
কারণ:
অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরজীবী।
প্রাথমিক চিকিৎসা:
ডিওয়ারমিং ওষুধ প্রয়োগ।
পরিবেশ পরিষ্কার রাখা।
প্রতিরোধের সাধারণ ব্যবস্থা:
১. মুরগির ঘর সবসময় শুকনো ও পরিষ্কার রাখা।
২. মুরগির জন্য সুষম খাদ্য সরবরাহ করা।
৩. নিয়মিত টিকা প্রদান করা।
৪. অপরিচ্ছন্ন খাবার বা পানি দেওয়া থেকে বিরত থাকা।
৫. বায়ো-সিকিউরিটি মেনে চলা।
৬. রোগ দেখা দিলে দ্রুত পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
সঠিক ব্যবস্থাপনা ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ব্রয়লার মুরগিকে রোগমুক্ত রাখা সম্ভব এবং এভাবে খামারের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়।
Comments
Post a Comment