গরুর প্রাথমিক রোগ ও চিকিৎসা

গরু পালনের ক্ষেত্রে সঠিক যত্ন ও রোগ প্রতিরোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গরুর বিভিন্ন প্রাথমিক রোগ এবং তাদের চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে রাখা দরকার। গরুর সাধারণ রোগ, লক্ষণ এবং চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

গরু

১. ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ (FMD বা খুরা-রোগ) ঃ

  • লক্ষণ:
    • মুখে, জিহ্বায় ও খুরে ফোসকা পড়ে।
    • জ্বর, খাবারে অনীহা।
    • গরুর হাঁটতে কষ্ট হয়।
  • চিকিৎসা:
    • পা পরিষ্কার রাখতে দিনে ২-৩ বার গরম পানিতে ডেটল মিশিয়ে ধুয়ে দিন।
    • ক্ষতস্থানে পোভিডন আয়োডিন ব্যবহার করুন।
    • ভেটেরিনারি ডাক্তারের পরামর্শে এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন নিন।
    • সঠিক সময়ে খুরা-রোগের টিকা দিন।

২. ডায়ারিয়া বা পাতলা পায়খানাঃ

  • লক্ষণ:
    • ঘন ঘন পায়খানা করা।
    • পানিশূন্যতা দেখা দেয়।
    • শরীর দুর্বল হয়ে যায়।
  • চিকিৎসা:
    • ১ লিটার পানিতে ওআরএস মিশিয়ে পান করান।
    • পানি বা স্যালাইন বেশি করে দিন।
    • এন্টিবায়োটিক বা প্রোবায়োটিক ব্যবহার করুন (ডাক্তারের পরামর্শে)।
    • পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করুন।

৩. ব্লোট (Bloat বা পেট ফাঁপা) ঃ

  • লক্ষণ:
    • পেট ফুলে ওঠা।
    • শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
    • গরু খাবার খেতে পারে না।
  • চিকিৎসা:
    • সরিষার তেল বা নারকেল তেল গরম করে মুখে দিন।
    • ভেটেরিনারি ডাক্তারের মাধ্যমে পেটের গ্যাস বের করার ব্যবস্থা করুন।
    • খাওয়ানোর আগে খাবার সঠিকভাবে শুকিয়ে নিন।

৪. কৃমি সংক্রমণঃ

  • লক্ষণ:
    • গরু দুর্বল হয়ে যায়।
    • দেহে অপুষ্টির লক্ষণ দেখা দেয়।
    • খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে যায়।
  • চিকিৎসা:
    • কৃমি প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত ডিওয়ার্মিং ট্যাবলেট খাওয়ান।
    • খাবার ও পানির পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।
    • ৩-৪ মাস অন্তর কৃমির ওষুধ দিন।



৫. মাস্তাইটিস (Mastitis বা স্তন্যপিণ্ডের প্রদাহ) ঃ

  • লক্ষণ:
    • দুধের পরিমাণ হঠাৎ কমে যায়।
    • স্তনে লালচে ভাব ও গরম অনুভব হয়।
    • দুধের সঙ্গে রক্ত বা পুঁজ মিশে যায়।
  • চিকিৎসা:
    • ক্ষতস্থান পরিষ্কার করুন।
    • প্রদাহনাশক এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করুন (ডাক্তারের পরামর্শে)।
    • দুগ্ধদানের পরে স্তন ভালোভাবে পরিষ্কার করুন।

৬. অ্যানথ্রাক্স (Anthrax) ঃ

  • লক্ষণ:
    • হঠাৎ জ্বর এবং ক্ষুধামন্দা।
    • নাক, মুখ এবং পায়খানা থেকে রক্ত বের হওয়া।
    • গরু দ্রুত মারা যেতে পারে।
  • চিকিৎসা:
    • রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত গরুকে আলাদা করে ফেলুন।
    • এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন প্রয়োগ করুন।
    • নিয়মিত অ্যানথ্রাক্স ভ্যাকসিন দিন।

৭. হিট স্ট্রোক বা গরমজনিত অসুস্থতাঃ

  • লক্ষণ:
    • অতিরিক্ত শ্বাস-প্রশ্বাস।
    • নাক ও মুখ দিয়ে লালা পড়া।
    • দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়।
  • চিকিৎসা:
    • গরুকে ছায়ায় রাখুন।
    • পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি দিন।
    • শরীর ঠাণ্ডা করার জন্য ঠাণ্ডা পানি ছিটিয়ে দিন।

৮. স্কিন ডিজিজ (ত্বকের রোগ) ঃ

  • লক্ষণ:
    • ত্বকে ফোসকা বা ঘা।
    • চুল পড়া।
    • চুলকানি বা জ্বালাপোড়া।
  • চিকিৎসা:
    • ক্ষতস্থানে এন্টিসেপ্টিক ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করুন।
    • স্কিন ইনফেকশনের জন্য সঠিক এন্টিবায়োটিক দিন।
    • পশুর চারপাশ পরিষ্কার রাখুন।

৯. গর্ভপাত (Abortion) ঃ

  • লক্ষণ:
    • গর্ভধারণের মাঝপথে ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যাওয়া।
    • গর্ভের রক্তপাত।
  • চিকিৎসা:
    • পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সঠিক চিকিৎসা করুন।
    • সংক্রমণ থেকে বাঁচতে টিকা দিন।
    • গর্ভবতী গরুকে চাপমুক্ত রাখুন।

১০. ক্যালসিয়াম ঘাটতি (Milk Fever) ঃ

  • লক্ষণ:
    • গরু দাঁড়াতে পারে না।
    • শরীর কাঁপা।
    • দুধ উৎপাদন হ্রাস।
  • চিকিৎসা:
    • ভেটেরিনারি ডাক্তারের মাধ্যমে ক্যালসিয়াম ইনজেকশন দিন।
    • খাবারের মাধ্যমে ক্যালসিয়াম সরবরাহ নিশ্চিত করুন।

১১. জ্বর (Fever) ঃ

  • লক্ষণ:
    • শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি।
    • দুর্বলতা ও অস্বাভাবিক আচরণ।
  • চিকিৎসা:
    • শরীর মুছে দিন ঠাণ্ডা পানিতে।
    • ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এন্টিপাইরেটিক ওষুধ দিন।
    • গরুকে বিশ্রামে রাখুন।

১২. নিউমোনিয়া ঃ

  • লক্ষণ:
    • শ্বাসকষ্ট।
    • কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়া।
  • চিকিৎসা:
    • উষ্ণ পরিবেশে গরুকে রাখুন।
    • এন্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করুন।
    • ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

১৩. পোকামাকড়জনিত রোগ (Tick-borne Diseases) ঃ

  • লক্ষণ:
    • ত্বকে ঘা ও চুলকানি।
    • রক্তশূন্যতা।
  • চিকিৎসা:
    • নিয়মিত ত্বক পরিষ্কার করুন।
    • টিক-মারার স্প্রে বা পাউডার ব্যবহার করুন।
    • প্রয়োজনে পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

১৪. গলার কাঁটা (Choke) ঃ

  • লক্ষণ:
    • গরু মুখ দিয়ে লালা ফেলে।
    • খাবার গিলতে পারে না।
  • চিকিৎসা:
    • ধীরে ধীরে গলার কাঁটা বের করার চেষ্টা করুন।
    • ভেটেরিনারি চিকিৎসকের মাধ্যমে পরবর্তী ব্যবস্থা নিন।

১৫. ভিটামিনের ঘাটতিঃ

  • লক্ষণ:
    • অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।
    • রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া।
  • চিকিৎসা:
    • ভিটামিন সম্পন্ন খাবার দিন।
    • ভিটামিন ইনজেকশন প্রয়োগ করুন (ডাক্তারের পরামর্শে)।


 পরিশেষে বলা যায় গরুর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে তাদের বাসস্থান পরিষ্কার রাখা, পুষ্টিকর খাবার দেওয়া এবং সময়মতো ভ্যাকসিন দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোগের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

Comments

Popular posts from this blog

হাঁস কত দিনে ডিম পাড়ে এবং ডিম পাড়া হাঁসের সঠিক পরিচর্যা

মাংস উৎপাদনের জন্য লাভজনক হাঁসের জাত ও তাদের পালন পদ্ধতি

দেশি মুরগি কত দিনে ডিম পাড়ে এবং ডিম পাড়া মুরগি সঠিক পরিচর্যা